শেয়ার বজার এভাবে চলতে থাকলে শেষ রক্ষা হবে না

১৯শে ডিসেম্বর ২০১০ দিনটি ছিল বাংলাদেশের শেয়ার বাজারের ইতিহাসে সর্বকালের কালোদিন – এ পর্যন্ত। এ ধকল থেকে যে সকল বিনিয়োগকারী কোনমতে বের হয়ে অআসতে পেরেছেন তাদেরকে ভাগ্যবান বলা যায়। কিন্তু তাদের এবছর শেষ রক্ষা হবে কিনা তা বলা নেহায়েত মুশকিল। কারণ, বছর বদলালে ও শেয়ার বাজারের অবস্থা কিন্তু সেই কালোদিনটির তুলনায় খুব বেশী বদলায় নাই।

শেয়ারবাজারে টানা তিন দিন ধরে বড় ধরনের দরপতনে আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা গতকাল বুধবার, ৫ই জানুয়ারী, ২০১১, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কার্যালয়ের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা ডিএসইর সামনের সড়ক প্রায় চার ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশ একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও জলকামান ব্যবহার করে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লেনদেন শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেয়ারবাজারের মূল্যসূচকে বড় ধরনের দরপতন ঘটতে শুরু করে। গতকাল লেনদেনের আধা ঘণ্টার মধ্যে সাধারণ মূল্যসূচক ১২০ পয়েন্ট কমে যায়। টানা দুই দিন দরপতনের পর গতকালও বড় ধরনের ধসের আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা লেনদেন ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শতাধিক বিনিয়োগকারী বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে কয়েক হাজার বিনিয়োগকারী তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থেকে ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কটি অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও ডিএসইর কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের স্লোগান দেওয়া হয়।

বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে আবর্জনা জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া কয়েকটি স্থানে টায়ারে আগুন জ্বালিয়েও বিক্ষোভ দেখানো হয়। তাঁরা চার-পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুর করেছেন বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে একদল বিনিয়োগকারী স্লোগান দিতে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে তাঁরা ব্যাংকের প্রধান ফটক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর বিনিয়োগকারীরা ডিএসইর সামনের সড়কে আবার অবস্থান নিলে পুলিশ তাঁদেরও ধাওয়া দেয়। এ সময় বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিলে পুলিশ কয়েকটি ভবনে গিয়ে আবার লাঠিচার্জ করে।

এর আগে বিক্ষোভকারীদের একটি প্রতিনিধিদল ডিএসইর কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বিভিন্ন যুক্তি ও ক্ষোভের কথা জানান।

গত কয়েক দিনের দরপতনের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গত বছরের শেষে পুঁজিবাজারে হঠাৎ দরপতনের যে ঘটনা ঘটেছিল, তার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতি অস্থিরতাকে দায়ী করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন বছরের শুরু থেকে এসইসি বাজারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি। তারপরও কেন এ ধরনের পতন, এর কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা কারও জানা নেই।

কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির মতে, বাজারে তারল্য-সংকটের কারণে এই পতন ঘটছে। পুঁজিবাজারে ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিতে পারছে না। এতে করে অনেক বিনিয়োগকারীর ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে না। অন্যদিকে একশ্রেণীর বিনিয়োগকারী পুঁজি বাঁচাতে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে শেয়ারের দাম কমছে।

আবার কেউ কেউ বলছেন, বিগত কিছুদিন ধরে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ায় বড় বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। নতুন করে তাঁরা কোনো ধরনের বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। ফলে বড় বড় বিনিয়োগকারীর অর্থ অলস পড়ে রয়েছে। এসব বড় বিনিয়োগকারী সচল হলেই বাজার আবার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।

কয়েকজন বিনিয়োগকারী বলেছেন, তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা থাকলেও মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউস থেকে শেয়ার না কেনার অনুরোধ করা হচ্ছে। কারণ তাঁরা শেয়ার ক্রয় করলে ওই পরিমাণ অর্থ জোগান দেওয়ার ক্ষমতা মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউসের নেই। তাঁরা আরও জানান, বর্তমানে যে পরিমাণ টাকার শেয়ার বিক্রি করছেন, হাউসগুলো থেকে ঠিক সেই পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনতে দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকার বাজার পরিস্থিতি: ডিএসইতে সূচকের নিম্নগতির মধ্য দিয়ে গতকাল লেনদেন শুরু হয়, যা দিনভর ওঠানামা করে। দিন শেষে সাধারণ মূল্যসূচক প্রায় ৩৩ পয়েন্ট কমে সাত হাজার ৯৪৮ পয়েন্টে এসে দাঁড়ায়। এ দিন ডিএসইতে এক হাজার ২৯ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা গত মঙ্গলবারের চেয়ে ১২৭ কোটি টাকা কম। মঙ্গলবার ডিএসইতে এক হাজার ১৫৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ২৪৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম কমেছে ১৫৮টির, বেড়েছে ৮০টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম।

চট্টগ্রাম শেয়ারবাজার: সিএসইতে গতকাল বুধবার বেশির ভাগ শেয়ারের দাম কমেছে। টানা তিন দিন দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তবে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ঘটেনি। গতকাল সিএসইর সব কয়টি সূচক ছিল নিম্নমুখী। মন্দাভাব শুরু হয় দিনের শুরু থেকেই। দিনশেষে মূল্যসূচক ২২১ পয়েন্ট কমে ২২ হাজার ৪২৫ পয়েন্টে নেমে আসে।

গতকাল লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১২১ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। সিএসইতে ১৭৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৩৭টির, কমে ১৪০টির ও অপরিবর্তিত ছিল দুটি কোম্পানির শেয়ার। -: সমাপ্ত :-

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। কাউছার ভূইয়াঁ ১৯৯১ – ২০১১।