মিথ্যা তথ্যে ৪০ কোটি টাকা তোলার প্রস্তাব! শেয়ার বাজারের কি কোন মা বাপ নাই?
খুলনা মহানগরের ৫১ খান এ সবুর সড়ক। খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড বা কেপিপিএলের প্রধান কার্যালয়। শুধু কার্যালয় নয়, কাগজে-কলমে কোম্পানির চার পরিচালকের স্থায়ী নিবাসও এটি। সব মিলিয়ে ভাড়াভিত্তিক ওই কার্যালয়ের আয়তন মাত্র এক হাজার বর্গফুট।
বাস্তবে সেখানে এই নামে কোনো কোম্পানির অস্তিত্বই নেই। পরিচালকদের স্থায়ী নিবাসও নেই। ওই ঠিকানায় আছে ‘ওয়েস্টার্ন ইন ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি আবাসিক হোটেল। অথচ এই ঠিকানা ব্যবহার করেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে কেপিপিএল। ‘মিথ্যা তথ্য’ দিয়ে কোম্পানিটি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে তুলতে যাচ্ছে ৪০ কোটি টাকা।
আইপিওর জন্য কোম্পানিটি যে বিবরণীপত্র বা প্রসপেক্টাস প্রকাশ করেছে, সেটি বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনায় এ রকম আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্লেষক ও শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব তথ্যকে ‘বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত’ বলে মনে করছেন।
বিবরণীপত্রের কোম্পানিটির দেওয়া ওয়েবসাইটেরও (www.lockpurgroup.com) কোনো অস্তিত্ব নেই। আর তথ্যের সত্যতা দেখার দায়িত্ব যাদের, সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দেড় বছরের বেশি সময় ধরে যাচাই-বাছাইয়ের পর ‘অতিরঞ্জিত’ ও মিথ্যা তথ্যে ভরা কোম্পানিটির বিবরণীপত্র অনুমোদন দিয়েছে।
জানতে চাইলে আইপিও বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএসইসির কমিশনার আরিফ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিবরণীপত্র একটি আইনি দলিল। সেখানে ভুল তথ্য দেওয়া অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ তিনি আরও বলেন, বিএসইসি সাধারণত তথ্যের সত্যতা যাচাই করে না। প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না সেটি দেখে। তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কোম্পানির মালিক, ইস্যু ব্যবস্থাপক ও নিরীক্ষকের। যদি কোনো তথ্য ভুল বা মিথ্যা দেওয়া হয় তাহলে বিএসইসি এই তিন পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বিএসইসির অনুমোদনের ভিত্তিতে আগামী রোববার (৪ মে) থেকে আইপিওর চাঁদা সংগ্রহে নামছে কেপিপিএল। আইপিওতে কোম্পানিটি ১০ টাকা অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালুতে প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করবে। বিবরণীপত্রের তথ্য অনুযায়ী, আইপিওতে চার কোটি শেয়ার ছাড়ার পর কোম্পানিটির মালিকানায় বর্তমান উদ্যোক্তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। ৬০ শতাংশেরও বেশি শেয়ার চলে যাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
খুলনা প্রিন্টিংয়ের আগে শেয়ারবাজারে আসা সর্বশেষ নয়টি কোম্পানির তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, ওই সব কোম্পানির কোনোটি ৪৯ শতাংশের বেশি শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ছাড়েনি।
২০১০ সালে বাজার ধসের আগে দেখা গিয়েছিল, কোম্পানির উদ্যোক্তারা নিজেদের বেশির ভাগ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ছেড়ে দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছিল। একপর্যায়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়। এ ধরনের ঘটনার সর্বশেষ উদাহরণ পদ্মা সিমেন্ট; যার উদ্যোক্তারা প্রায় শতভাগ শেয়ার কৌশলে সাধারণের হাতে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এখন আদালতের নির্দেশ পদ্মা সিমেন্টের অবলুপ্তির প্রক্রিয়া চলছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য অনুষদের প্রধান ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক মোহাম্মদ মূসা বলেন, কোনো ভালো ও লাভজনক কোম্পানির সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার উদ্যোক্তারা কখনোই সাধারণের হাতে ছেড়ে দিতে চাননি। যখন এ ধরনের পরিস্থতি ঘটে তখন এটির পেছনে উদ্যোক্তাদের খারাপ উদ্দেশ্য থাকে।
আকাশচুম্বী ব্যবসা
কাগজ ও পলিথিনের সামগ্রী (বিশেষ করে কাটন, স্টিকার, পলি প্রিন্টিং সামগ্রী) উৎপাদনকারী কেপিপিএল ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে খুলনায় যাত্রা শুরু করে। ২০১১ সালে সেটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়।
আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, ২০০৯ সালে কোম্পানিটি প্রায় ১১ কোটি টাকার ব্যবসা (টার্নওভার) করে। ২০১০ সালে তা বেড়ে হয় ৩৪ কোটি টাকা। ২০১১ সালে পাবলিক লিমিটেডে পরিণত হওয়ার বছরে ওই ব্যবসা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১১৯ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ২৫০ শতাংশ ব্যবসা বেড়েছে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২০৮ ও ১৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১২ সালের শেষের দিকে কোম্পানিটি বিএসইসিতে আইপিও আবেদন জমা দেয়।
কমেছে মুনাফা
বিবরণীপত্রে বলা হয়েছে, প্রায় এক কোটি তিন লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করতে পারলে কোম্পানিটির লাভ-লোকসান সমান সমান থাকে। কিন্তু আর্থিক বিবরণীর তথ্যে দেখা যায়, ব্যবসা বাড়লেও মুনাফা বাড়েনি।
২০১০ সালে সমাপ্ত আর্থিক বছর শেষে কোম্পানিটি ৩৪ কোটি টাকার ব্যবসা করে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে প্রায় তিন কোটি ৪১ লাখ টাকা। এরপর ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে কোম্পানিটি যথাক্রমে ১৩, ১১ ও সাড়ে সাত কোটি টাকা মুনাফা করে। উৎপাদিত পণ্যের ৬৩ শতাংশই বিক্রি করে একই মালিকের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে।
বিবরণীপত্রের এসব তথ্যের অধিকাংশই ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও অতিরঞ্জিত’ বলে মন্তব্য করে বিশ্লেষক মোহাম্মদ মূসা বলেন, যে কোম্পানি ২০৮ কোটি টাকার ব্যবসা করে তার লাভ-লোকসান কখনোই এক কোটি টাকার বিক্রিতে সমান সমান হওয়ার কথা না। কারণ, ২০৮ কোটি টাকার ব্যবসা পেছনে কয়েক কোটি টাকার স্থায়ী খরচ থাকে।
মোহাম্মদ মূসা আরও বলেন, প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং খাতের ব্যবসায় লাভের হার সাধারণত ৫ শতাংশের বেশি নয়। সে ক্ষেত্রে এই কোম্পানিটি চার কোটি শেয়ার বেড়ে গেলে এটির মুনাফা আরও কমে যাবে। কারণ, কোম্পানিটি আইপিওর টাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণ করবে না। ব্যাংকের ঋণ শোধ ও চলতি মূলধন হিসাবে ওই টাকা কাজে লাগাবে। এসব কারণে কোম্পানিটির আইপিও আপাতত স্থগিত রেখে দ্রুত তদন্তের উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করেন তিনি।
সরেজমিনে: আমাদের খুলনা প্রতিনিধি সম্প্রতি কোম্পানির প্রধান বা করপোরেট কার্যালয়ের ঠিকানায় গিয়ে সেখানে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও এবং ‘ওয়েস্টার্ন ইন ইন্টারন্যাশনাল’ নামের আবাসিক হোটেল খুঁজে পান। জানা গেছে, ওয়েস্টার্ন ইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল ও কেপিপিএলের মালিক একই। হোটেলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, হোটেলে বর্তমানে কোনো কোম্পানির কার্যালয় নেই। আর একই হোল্ডিংয়ের ‘নুর ভিলা’ নামের অপর বাড়িটিতে রয়েছে ‘সেফ’ নামের একটি এনজিওর কার্যালয়।
যোগাযোগ করা হলে কেপিপিএলের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী পরিচালক আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খুলনায় কোম্পানির যে ঠিকানাটি দেওয়া হয়েছে, সেটি একটি হোটেল। ওই হোটেলের দ্বিতীয় তলায় কোম্পানির অফিস।
প্রথমে তিনি কার্যালয়টি খুলনা থেকে বাগেরহাটে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন। অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এখনো খুলনার অফিসটি আছে।
বিবরণীতে চারজন পরিচালকের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে কোম্পানির কার্যালয়ের ঠিকানা ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হয়তো ভুলে এটি হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, কোম্পানিটির আইপিও বিবরণীপত্রে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করার দাবি রাখে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত সেসব তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। আর ভুল তথ্য দিলে শাস্তির বিধান করা।
-: সমাপ্ত :-