ভেনামী চাষে হোঁচট খেয়ে বাগদায় ফেরৎ

২০০৯ খ্রীষ্ঠাব্দ থেকে ভারতে পাইকারী হারে ঐতিহ্যবাহী বাগদা (ব্ল্যাক টাইগার) চিংড়ি চাষের পরিবর্তে ভেনামী (হোয়াইটলেগ) চিংড়ি চাষের সূত্রাপাত ঘটে। সেসময় ভেনামীর উচ্চফলন, বেশী লাভ এবং রোগবালাই সহনশীলতার প্রতিশ্রুতি চিংড়ি চাষী এবং বিনিযোগকারীদের মধ্যে উচ্চ আকাঙ্খার সঞ্চার করেছিল।

ভেনামী চাষ ভারতকে অল্প সময়ের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে সাহায‍্য করে এবং একটা ভাল অবস্থানে নিয়ে যায় যা গত পাঁচ বছরে ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ চিংড়ি রপ্তানিকারকে পরিণত করে। কিন্তু রপ্তানি যে পরিমাণে বেড়েছে নীট মুনাফা সেভাবে বৃদ্ধি না পাওয়াতে চিংড়ি চাষীরা ও বিনিয়োগকারীগণ হতাশ হয়ে পড়ে। ভারতের চিংড়ি চাষী ও আর্ন্তজাতিক চিংড়ি খাত বিশেষজ্ঞদের মতে মুনাফা কমে যাওয়ার অন‍্যতম প্রধান কারণসমূহের মধ‍্যে দরপতন, রোগবালাইয়ের আক্রমণ ও ভেনামীর উচ্চফলন বিজ্ঞাপন মোতাবেক ফলন অর্জন করতে না পরা।

দরপতনের প্রধান কারণ হিসাবে চাষীরা মূলতঃ বিশ্বব‍্যাপী ব‍্যপকহারে ভেনামী চাষকে দায়ী করেছেন। কারণ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পরিসংখ‍্যাণ মতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধশতাধিক দেশে ভেনামী চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে। সেতুলনায় বাগদা চিংড়ি চাষ হয় মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দেশে।

দরপতন আর মুনাফা হারানোর কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক চাষী ভেনামী থেকে মুখ ফিরিয়ে বাগদা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাগদা চিংড়ি চাষীরা তুলনামূলক ভাল মুনাফা বয়ে এনেছে। ত্তলন্দাজ সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ থেকে রূপান্তরীত চিংড়ি শিল্প বিশ্লেষক জনাব ভিইলেম ফান ড‍্যার পিয়েল সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে এই ধরনের প্রতিবেদনগুলি আরও নিশ্চিত করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, “অনেক ভারতীয় ভেনামি চাষী আর তাদের ব্যবসা থেকে লাভ উপার্জন করতে পারছেন না। তাদের আয় সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, এমনকি সফলভাবে ভেনামি চাষের পরেও কৃষকরা মুনাফা অর্জন করতে হিমশিম খাচ্ছেন।

একটি মৌলিক অর্থনীতি, অবশ্যই, চাহিদা এবং সরবরাহ নির্ভর, যা অন্য কোনও পণ্যের মতো চিংড়ি চাষ এবং বাণিজ্যের মূল্য এবং লাভজনকতা নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র কৃষকরা খুব শীঘ্রই সারা বিশ্বের উচ্চ-প্রযুক্তির নিবিড় ভেনামি চাষকারী বৃহদাকার কর্পোরেশনগুলির সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো অবস্থানে থাকবে- এমন সম্ভাবনা খুব কমই রয়েছে, তবে বাংলাদেশী বাগদা চাষকারীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাগদা চিংড়ি চাষ করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ৮০০,০০০ এরও বেশি, প্রধানত পারিবারিক মালিকানাধীন, ক্ষুদ্র-পরিসরের চিংড়ি চাষিরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ৩০০,০০০ হেক্টর জমিতে বাগদা চিংড়ি এবং মিঠা পানির বড়ো গলদা চিংড়ি চাষ করে আসছেন।

চাহিদার দিক থেকে, অনেক ইউরোপীয় ক্রেতা এবং ভোক্তারা, চীন ও জাপানে উচ্চ চাহিদা ছাড়াও, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যবিধি এবং টেকসই মান সম্মত উপায়ে চাষকৃত আরও উচ্চ মানের গাঢ় অভিন্ন রঙের বাগদা চিংড়িকে বিশ্ব বাজারে স্বাগত জানাতে চায়। বর্তমানে, বাংলাদেশে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, অপরদিকে ভিয়েতনামে উত্পাদিত চিংড়িগুলি ইউরোপের বেশিরভাগ বাজারের জন্য খুব ব্যয়বহুল বলে সেখানকার আমদানিকারকগণ মনে করেন।

চিংড়ি শিল্পমালিক, মৎস্যখাদ্য ও সংশ্লিষ্ট রাসায়নিক প্রস্তুতকারকদের এক দশক ধরে ক্রমাগত তদবির এবং রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য তীব্র চাপের প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের মৎস্য অধিদপ্তর ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প অনুমোদন করেছে যা পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে ‘নিষিদ্ধ’ বিদেশী এই প্রজাতি চাষের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিলো। খুলনাভিত্তিক একটি বেসরকারি কোম্পানি এবং সাতক্ষীরা ভিত্তিক একটি এনজিও যৌথভাবে এই প্রকল্পের পরীক্ষামূলক বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছে। ভেনামি পোনা, খাদ্য ও কারিগরী সহায়ক আমদানিকরা, পরীক্ষামূলক চাষ এই কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল । স্থানীয় প্রজাতির জন্য বিভিন্ন রোগ ও ভাইরাস বয়ে আনতে পারে এই ভয়ে ভেনামি চিংড়ি চাষ পরীক্ষসমূলক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই ভেনামি চাষ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।

অবাক করার মতো বিষয় হলো এই প্রকল্পের প্রাথমিক ফলাফল যাচায়-বাছাই ছাড়াই সফলতা আকারে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ এর একটি কারণ হতে পারে, যেন তারা বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ ও উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করেন, এবং এর দ্বারা সম্ভাব্য পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও জীববৈচিত্র্যের ঝুঁকি উপেক্ষা করে পরিবেশে বিদেশী এই প্রজাতিকে মুক্ত করে দেন।

আক্ষেপের বিষয় হলো বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য প্রচারিত বিপণন সামগ্রী এবং নানাবিধ তদবির সভায় বিজ্ঞাপিত আর্থ-সামাজিক বিষয় গুলিতে পরিবেশগত এবং জীব-বৈচিত্র্যের উপর ঝুঁকিআছে এমন বিষয়গুলো ও তুলেধরা হয়নি ! অথচ এই ঝুঁকি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বাগদা চিংড়ির প্রাকৃতিক আবাসস্থলে স্থানীয় বাগদা প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে ! এই বাস্তবতায় যেখানে এমন স্পর্শকাতর  বিষয়গুলোও উপেক্ষা করা হয়েছে, সেখানে এফএও এবং শিল্প বিশ্লেষকদের দ্বারা চিহ্নিত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ভেনামি কৃষকদের সাম্প্রতিক আর্থিক সংগ্রামকে বিশ্লেষণ করার মত অভিপ্রায় সুদূরপ্রসারী।

একটি মৌলিক ও যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন হলো, নিবিড় পদ্ধতিতে ভেনামি চাষ, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-পরিসরের কৃষকদের দ্বারা বাগদার ঐতিহ্যগত ও প্রাকৃতিক চাষ প্রক্রিয়ার তুলনায় তথাকথিত প্রতিশ্রুত উচ্চতর ফলন ব্যতীত আর কোন অতিরিক্ত মান-মূল্য যুক্ত করতে পারে? যেখানে বিবেচনা করতে হবে যে ভেনামি চাষের জন্য থাইল্যান্ড থেকে বিমানে করে পোনা আমদানি, ভারত থেকে খাদ্য এবং দক্ষ কারীগর আনা সহ, আনুসঙ্গিক খরচ যোগ হবে। আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশে ভেনামির পাইলট প্রকল্পের প্রযুক্তিগত অংশীদার, জে. পি. এগ্রো কেয়ার মূলত বিস্তৃত ডিলার নেটওয়ার্ক সমৃদ্ধ মৎস উৎপাদনের রাসায়নিকের একটি নেতৃস্থানীয় প্রস্তুতকারক।

সর্বশেষে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশ্বব্যাপী ভেনামির বাজার দখলের জন্য উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর বড়-বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গুলোর যে তীব্র প্রতিযোগিতা বিদ্যমান, সেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশর পরাজয় সহজেই অনুমেয়। এই অনুমানের বাস্তবরূপ কয়েকবছরের মধ্যেই দৃশ্যমান হবে যদি ভেনামি চাষের বাণিজ্যিক উৎপাদন সরকারিভাবে অনুমোদন দেয়া হয়।

বিদেশী প্রজাতি ভেনামি চাষের দিকে না গিয়ে এর পরিবর্তে, আমাদের ঐতিহ্য বাগদা চাষে মনোযোগী  হওয়ার উচিত। বাগদা চিংড়ি চাষ, উৎপাদন, বিপণন এবং রপ্তানির দুর্বলতাগুলি চিহ্নিত করা এবং প্রকৃত সমাধান খুঁজে বের করা, একই সাথে স্থানীয় বাজারের বিকাশ ঘটানো তে মনোযোগী হওয়া যেতে পারে। ইতিমধ্যে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ও পণ্য বিপণন ব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যা আগামী ‘৩০ জুন ২০২২’ পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে উন্মোচিত হবে।

অতএব, বাংলাদেশে নীতিগত সিদ্ধান্তগুলি অবশ্যই খুব ভালভাবে গ্রহণ করা উচিত, গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত।  বিচক্ষণতার সাথে চিংড়ি শিল্প, লক্ষ লক্ষ কৃষক ও শ্রমিকদের সর্বোত্তম এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থে এবং উচ্চমানের বাগদা চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশের বিশ্বব্যাপী নেতৃস্থানীয় অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের কাজ করা উচিত।

-ঃসমাপ্তঃ-